সৌদি প্রবাসীর এক নারীর করুন কাহিনী যা শুনলে আপনিও
ভাগ্য ফেরাতে এমন হাজারো নারী শ্রমিক প্রতি বছর বিদেশে পাড়ি জমান। কিন্তু সেখানে অনেককেই মানবেতর জীবন-যাপন করতে হয়। যৌন নির্যাতন, খেতে না দেওয়া, বেতন না দেওয়া, কাজে ভুল হলেই মারধর, এক বাড়ির কথা বলে একাধিক বাড়িতে মাত্রাতিরিক্ত কাজ করানো, মিথ্যা মামলা দেওয়া- এমন নানা ধরণের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। কেউ কেউ এক বছর ধরে সেফ হোমে আছেন এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম থেকে জানা যায়, ১০০ জনের বেশি নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন।
বিদেশে গিয়ে নিজেদের ভাগ্য কতটুকু ফেরাতে পারছেন নারী শ্রমিকরা? সুন্দর ভবিষ্যত্ বিনির্মাণে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় তারা বিদেশে যাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু অনেকেই যৌন নির্যাতনসহ নানারকম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ অভিবাসী নারী শ্রমিকরা পুরুষদের চাইতে কম উপার্জন করলেও তারা তাদের আয়ের ৯০ শতাংশ টাকাই দেশে পাঠিয়ে দেন। যেখানে পুরুষ শ্রমিকরা পাঠান মাত্র ৫০ শতাংশ। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের নারীদের রয়েছে বড় ভূমিকা। কিন্তু কেমন আছেন আমাদের অভিবাসী নারী শ্রমিকরা? গত ৭ ফেব্রুয়ারি সিরডাপে ও ২০ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বিদেশ থেকে আসা ভুক্তভোগী নারীরা তাদের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। তারা বিদেশে গিয়েছিলেন নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে। কিন্তু ফিরেছেন তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বর্তমানে ৭ লাখ নারী কর্মী বিদেশে অবস্থান করছেন। শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫ জন নারী শ্রমিক দেশের বাইরে গেছেন।
বাংলাদেশে মহিলা পরিষদের তথ্য মতে, ২০০৩ সালে সরকার আংশিক এবং স্বল্পদক্ষ নারীদের অভিবাসনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত অভিবাসীদের মধ্যে যেখানে নারী অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল মাত্র এক শতাংশ। নীতিমালায় পরিবর্তনের কারণে ২০০৯ সালে এই হার উন্নীত হয় ৫ শতাংশে।
বাংলাদেশ থেকে যাওয়া নারী শ্রমিকরা সকলেই যে সমস্যার মুখোমুখি হন তা ঠিক নয়। জর্ডানে পার্লারের কাজ করা এক নারী শ্রমিক দেশে ফিরে জানান, ৯ মাস যাবত দেশে আছেন, আবার বিদেশে যাবেন। বিউটি পার্লারে কাজ করে তিনি মাসে ১৮ হাজার টাকা এবং ওভার টাইম মিলিয়ে পান মোট ৩০ হাজার টাকা। তিনি চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন। কোন সমস্যা হয়নি। তার পরিবার তার আয়ে স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছে, তিনি পরিবারে মূল্যায়ন পাচ্ছেন। সমাজে তার মর্যাদা বেড়েছে।
আরেকজন শ্রম অভিবাসী নাছিমা বেগম জানান, ২ বছর পূর্বে তিনি ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ওমান যান, যেখানে ৯ দিন থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হন। নাছিমা বেগমকে বলা হয়েছিল তাকে এমন পরিবারে কাজ করতে দেওয়া হবে যে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৩, কিন্তু তাকে ৭টি পরিবারে কাজ করতে দেওয়া হয়। তিনি সেখান থেকে স্বামীর সাথে যোগাযোগ করেন, স্বামী ৩০ হাজার টাকা পাঠালে তা দিয়ে দেশে ফেরত আসেন।
বাংলাদেশ থেকে সাধারণত লেবানন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, ওমান, মরিশাস, কুয়েত, মালয়েশিয়া, বাহরাইন, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিকরা কাজ করতে যাচ্ছেন। এর মধ্যে গৃহকর্মী হিসেবে নারী শ্রমিকদের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হলেও নির্যাতনের শিকার তারাই বেশি হন।
অভিবাসী নারী শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ডা. মালেকা বানু জানান, অভিবাসী কর্মীদের ডাটাবেজ তৈরি করে তথ্য সংরক্ষণ করা, চাকরির নামে বিদেশে পাচারকৃত ভিকটিমকে দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থাসহ আইনগত ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, চিকিত্সা, ক্ষতিপূরণ ও অর্থসহায়তার বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। এছাড়া তিনি মানবপাচরের শিকার ব্যক্তি-বর্গের ক্ষতিপূরণ ও অর্থসহায়তা নিশ্চিত করতে তহবিল গঠন করার সুপারিশ করেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব ড. নমিতা হালদার ইত্তেফাককে বলেন, যে সকল বিষয়ে অভেযোগ এসেছে আমরা তা দূর করতে বিজ্ঞজনদের সাথে কথা বলছি। তাদের মতামত নিচ্ছি। সেই অনুযায়ী কাজ করার বিষয়ে আমরা আন্তরিক।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেন, নারী কর্মী মানেই সবাই প্রতারণা আর নির্যাতনের শিকার-একথা ঠিক নয়। অনেক নারী কর্মী ভালোভাবে কাজ করছেন। আমরা নার্সসহ কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ শ্রমিক পাঠনোর জন্য কাজ করছি। কারণ দক্ষ শ্রমিক বিদেশে গেলে নির্যাতনের শিকার কম হবেন।