যেদিন অবসর নেবেন মাশরাফি!
আগেরদিন মাশরাফি বিন মর্তুজার খেলা অমন একটা সাহসী ইনিংসের স্মৃতি রোমন্থন করেই যে কেটে গেছে সময়টা! বীর বন্দনার জন্য টুর্ণামেন্টের মাঝে এরকম একটা বিরতি খুবই দরকার ছিল!
কদিন আগে জার্সি নম্বর পাল্টে তিনি শুন্য নিয়েছেন! এমন পারফরম্যান্স দেখে অনেকেরই আফসোস- আহা, মাশরাফি যদি আবার জাতীয় দলের হয়েও শুন্য থেকে শুরু করতে পারতেন!
ক্যারিয়ারে বল হাতে অবিস্মরণীয় সব স্পেল তো আছেই; এমনকি ব্যাট হাতেও রয়েছে তাঁর দারুণসব ইনিংস। ইনজুরির সর্বণাশা থাবা তাঁকে পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার হয়ে উঠতে না দিলে কী হবে; সময় সময় ‘ঘাড়ের রগটা’ বাঁকা করে নিজেকে চ্যালেঞ্জ করে ঠিকই জিতে নিয়েছেন মাঠের চ্যালেঞ্জ!
রান, উইকেট, ক্যাচ কিংবা দূর্দান্ত ফিল্ডিং- মাশরাফির মাঠের পারফরম্যান্স পরিসংখ্যানের পাতায় স্বযত্নে সংরক্ষিত হচ্ছে। তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু পরিসংখ্যানের এতটুকু সাধ্য নেই তাঁকে তুলে ধরার! শুধু পারফরমার মাশরাফি সম্ভবত: বড় ব্যবধানেই পরাজিত হবেন ব্যক্তি মাশরাফি ও অধিনায়ক মাশরাফির কাছে!
মাশরাফির হৃদয়ের উদারতা ও ব্যক্তিত্বের বিশালতা মাপার কোনো যন্ত্র আবিস্কৃত হয় নি। তাঁর ক্রিকেটীয় মেধার পরিধি অনুমান করাও অনেক কঠিন ব্যাপার। রেকর্ডপত্র কিংবা পরিসংখ্যান এসব তুলে ধরতে ব্যর্থ! আমরা ভাগ্যবান, মাশরাফির ক্যারিয়ারটা স্বচক্ষে দেখছি বলে! পরের প্রজন্ম ভিডিও ফুটেজ আর লেখা পড়ে কতটাই বা চিনতে পারবে একজন মাশরাফিকে!
খুব পেছনে ফিরে যাওয়ার দরকার নেই। চলমান বিপিএলের দিকেই একটু তাকিয়ে দেখুন না- মাশরাফি কতটা স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন! যতটা না ব্যাট-বলের কীর্তিতে, তার চাইতেও অনেক অনেক বেশি নেতা ও অভিভাবকসূলভ মহত্বে! পেশাদারিত্ব আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবরণেও অন্য মাশরাফির এই রুপ যেন আরেক স্বর্গীয় দৃশ্য! যেখানে পক্ষ-বিপক্ষ আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা দুরে পালিয়ে ক্রিকেটেরই জয়গান!
চিটাগংয়ের সঙ্গে রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ শেষ হতেই যেমন ছুটলেন তাসকিন আহমেদের দিকে! প্রতিপক্ষ হলেও জাতীয় দলে তো সতীর্থ। সম্ভবত, গত বিশ্বকাপের সময় এক একটি উইকেট পাওয়ার পর তাসকিন-মাশরাফি শুন্যে লাফিয়ে একে অন্যের সঙ্গে বুক ঠোকাঠোকির দৃশ্য ক্রিকেটে অভূতপূর্ব এক দৃশ্য হয়ে আছে! পেরেরার হাতে শেষ বলে ছক্কা খাওয়া সেই তাসকিনের কাঁধে হাত রেখে দিয়েছেন কিছু পরামর্শ, এরকম পরিস্থিতিতে ইয়র্কার দেয়ার কথা বলেছেন। মানসিকভাবে খানিকটা বিপর্যস্ত তাসকিন এতে নিশ্চয় কিছুটা হলেও উজ্জীবিত হয়েছেন।
চিটাগংয়ের সঙ্গে প্রথম মোকাবেলায় শুভাশিসের সঙ্গে উইকেটের মাঝে মাশরাফির বাদানুবাদের কথা মনে আছে? ম্যাচ শেষ না হতেই চারিদিক থেকে সমালোচনা আর নিন্দার তীর যখন শুভাশিসকে তীব্রভাবে বিদ্ধ করার পটভুমি তৈরি করছিল, তখন সিনিয়র হিসেবে দায়িত্বের তাগিদে এগিয়ে এসেছেন মাশরাফি নিজেই। সেই রাতে শুভাশিসকে নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে হাসিমুখে সব মিটমাট করে সবাইকে এই ইস্যুতে আর বাড়াবাড়ি না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
রংপুরের সঙ্গে জিততে জিততে অল্পের জন্য হেরে গিয়েছিল সিলেট। শেষ বল হওয়ার পর সিক্সার্সের অধিনায়ক নাসির হোসেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাঠের মধ্যেই সান্ত্বনা দিয়েছেন মাশরাফি। আবার দারুণ ইনিংস খেলা সাব্বির রহমানকেও দারুণ ইনিংসের জন্য পিঠ চাপড়ে দিতে ভুলেন নি। মাথার উপর এরকম অভিভাবকসূলভ ছায়া থাকলে ম্যাচ হারের কস্ট তো কমে যাওয়ারই কথা।
ঢাকার বিপক্ষেও রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ জিতলো রংপুর। পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠানের আগে নিজে এগিয়ে গিয়ে একটু মনমরা সাকিবের কাঁধে হাত রেখে কী যেন বললেন মাশরাফি! হয়তো উত্তরসূরীকে জাতীয় দলের নেতৃত্ব দেয়ার সময় এরকম পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে কিছু টিপস দিয়ে থাকবেন। একটু পর দেখা গেলো সাকিবের মুখে খানিকটা হাসির ঝিলিক!
খুলনার সঙ্গে জয়ের দারুণ ক্ষেত্র তৈরি করেও রংপুর অল্পের জন্য ম্যাচ হেরে যায়। দলের পরাজয়ের শোক বুকে লুকিয়ে মাশরাফি ঠিকই প্রশংসায় মেতে উঠেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের। টাইটান্স অধিনায়কের অসাধারণ নেতৃত্ব ও সাবলীল ব্যাটিংয়ের জন্য বাহবা দিতে এতটুকু কুন্ঠাবোধ হয় না তাঁর! কুমিল্লার বিপক্ষে কাছে গিয়ে ম্যাচ হারের পরও তামিম ইকবালের সঙ্গে মাশরাফির সৌহার্দ্য বিনিময় ছিল আন্তরিকতা আর ভালোবাসায় মাখানো।
শেষ পর্যন্ত রংপুর রাইডার্সকে কতটা সাফল্য এনে দিতে পারবেন মাশরাফি, তা এখনই বলার সুযোগ নেই। কিংবা ব্যাট-বল হাতে কী করবেন সেটাও অজানা। তবে ঘটনা যাই হোক, এই ২০১৭ বিপিএলে এখন পর্যন্ত ব্যক্তি মাশরাফির যে কীর্তিকলাপ দেখছেন, স্মৃতির কোলাজে এই দৃশ্যগুলো কিন্তু জাগরুক হয়ে থাকবে অনন্তকাল! চাইলেও ভোলা যাবে না একটুও!
প্রিয় দলের জয়-পরাজয় ছাপিয়ে মাশরাফির দারুণ কোনো ইনিংস কিংবা অসাধারণ একটা স্পেল কী খুশির জোয়ারই না বইয়ে দেয় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ছোট্ট ব-দ্বীপে! তার সাফল্যে আপ্লুত হয়ে ডায়াবেটিস রোগীরাও মিস্টি খায়! হার্টের রোগীও সাবাস বলে চিৎকার দেয়!
ইনজুরির থাবা বসানো নড়বড়ে শরীর হলেও চওড়া বুকে ক্রিকেট, সতীর্থ আর দেশের জন্য কতটা ভালোবাসা জমা রেখেছেন মাশরাফি? এই প্রশ্নের উত্তর বোধহয় তিনি নিজেও জানেন না! তার জন্য আপামর জনসাধারণের ভালোবাসাও তো মাপা সম্ভব না! শেষ ইনিংসটি আবারও প্রমান করলো তা।
এসব দেখে শুনে একটা প্রশ্ন মনের মাঝে খচখচ করছে ভীষণ!
আচ্ছা, মাশরাফি যেদিন লাল-সবুজের জার্সি গায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেবেন জাতীয় দল থেকে; সেদিন কী অবস্থা হবে বাংলাদেশে? আবেগ, অনুভুতি আর ভালোবাসার ত্রিমুখি স্রোতে হারানোর বেদনার তীব্রতা কেমন ধাক্কা দেবে সেদিন? কেউ কী আগাম অনুমান করতে পারছেন কিছু!