| ঢাকা, শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

অলক কাপালি : হতভাগা এক ক্রিকেটারের নাম

খেলাধুলা ডেস্ক . স্পোর্টস আওয়ার ২৪
২০১৭ নভেম্বর ২৮ ০১:৩২:৪৩
অলক কাপালি : হতভাগা এক ক্রিকেটারের নাম

এনামুল হক জুনিয়র, আফতাব আহমেদ এবং শাহরিয়ার হোসেন’রা ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেদের প্রতিভা ও সামর্থ্যের প্রমাণ দিলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মেলে ধরার খুব বেশি সুযোগ পাননি। কারণে হোক কিংবা অকারণে হোক ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্ম করার পরও এইসব অদম্য প্রতিভাবানরা বারংবার অবহেলার শিকার হয়েছেন। এমনই একজন হতভাগা ক্রিকেটারের নাম অলক কাপালি।

অলক কাপালি বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক আক্ষেপের নাম। এক হাহাকারের নাম। অকালে ঝরে পড়া এক নক্ষত্রের নাম। বাংলাদেশের ক্রিকেটে যার আবির্ভাব হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো। অলকের সহজাত নান্দনিক ব্যাটিং স্টাইল ছিল অনেকটা চোখের প্রশান্তি। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিং আর ফিল্ডিংয়েও মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন এই ক্রিকেট প্রতিভা। অলকের ঝলক বেশ কিছুদিন ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য দৃষ্টির খোরাক ছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেটের চরম দুঃসময়ে তাঁর আবির্ভাব ঠিক অবতাররূপে। ট্রেডমার্ক কাভার ড্রাইভ, দৃষ্টিনন্দন সুইপ, শ্লথসুইপ, স্কয়ার কাট ও দ্রুত রান করার ক্ষমতা এবং স্বকীয় স্টাইল তাঁকে অতি অল্পসময়ে আইকন ক্রিকেটারের খ্যাতি এনে দিয়েছিল। অলক কাপালিকে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে প্রতিভাবান ও স্টাইলিশ ক্রিকেটার হিসেবে ধরা হয়। মূলত ডানহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হলেও বিরল প্রজাতির লেগব্রেক বোলিংয়ে নিজের পারদর্শিতা প্রমাণ করেছেন বারংবার। তবে দলে কখনো খেলেছেন ব্যাটসম্যান হিসেবে, আবার কখনো খেলেছেন অলরাউন্ডার হিসেবে। তিনি ব্যাটসম্যান, না অলরাউন্ডার; এই আইডেন্টিটি সংকট ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় জুড়ে।

১৯৮৪ সালের ১ জানুয়ারি সিলেট শহরে অলকের জন্ম। টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে ২০০২ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে অভিষেক মাত্র ১৮ বছর বয়সে এবং টি২০ ক্রিকেটে অভিষেক ২০০৭ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তাঁর ব্যাট-বল সমানভাবে কথা বলতো। একজন চৌকষ খেলোয়াড় হওয়ার সব ধরণের গুণাবলি অলকের মধ্যে ছিল।

২০০২-২০০৩ সাল ছিল অলকের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সেরা সময়। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হোম সিরিজে ৩য় ওয়ানডেতে ১০ টি চারের মাধ্যমে ৯২ বলে ৮৯ রানের লড়াকু এক ইনিংস খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের জাত চেনান। একই সিরিজের ১ম টেস্টে ৫২ এবং ২য় টেস্টে ৮৫ রানের নান্দনিক এক ইনিংসও উপহার দেন।

২৯ আগস্ট, ২০০৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩ ম্যাচ টেস্ট সিরিজের ২য় টেস্টে সাব্বির আহমেদ, দানিশ কানেরিয়া ও উমর গুলকে আউট করে প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে মাত্র ১৯ বছর ২৪০ দিন বয়সে হ্যাট্রিক করার বিরল গৌরব অর্জন করেন। ৩ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ১ম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে ৮৫ বলে দৃষ্টিনন্দন এক সেঞ্চুরি হাঁকান। এটি ছিল দেশের পক্ষে সবচেয়ে দ্রুততম ওয়ানডে সেঞ্চুরি।

২০০৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিষাদময় অধ্যায় সূচিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক মুলতান টেস্ট; বাংলাদেশ ক্রিকেটে চির আক্ষেপের এক গল্প। যে গল্পের সাথে জড়িয়ে আছে হতভাগা অলক কাপালির নাম। ম্যাচে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে ২৮১ রানের জবাবে পাকিস্তান মাত্র ১৭৫ রানে অল আউট হয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে বড় লিডের জন্য ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ ৭৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে। এরপর ব্যাটিং করতে নামেন অলক কাপালি। পাক প্রেসার সাব্বির আহমেদের একটা বাউন্সি বল হেলমেটের ফাঁকা দিয়ে বাম চোখের উপর আঘাত করলে রক্তাক্ত হন কাপালি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে ব্যাট চালাতে থাকেন এই লড়াকু টাইগার। পরক্ষণেই আবার আঙ্গুলে আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। ৭ উইকেট পড়ে গেলে আবার ইনজুরি নিয়ে ব্যাটিং করতে মাঠে নামেন। ব্যক্তিগত ২২ রানে অভিষিক্ত ইয়াসির আলির একটা বল ব্যাটের কানায় লেগে উইকেটের পেছনে উইকেটকিপার রশিদ লতিফের কাছে গেলে ড্রাইভ দিয়ে বল ধরার সময় হাত ফসকে পড়ে যায়। মাটি থেকে বল কুড়িয়ে আবেদন করলে আউট ঘোষণা করেন লংকান আম্পায়ার অশোকা ডি সিলভা।

অলক কাপালির বিরুদ্ধে অশোকার এই ভুল আউটটি শেষ পর্যন্ত মুলতান টেস্টের জয়-পরাজয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিল। দুর্দান্ত ব্যাট করতে থাকা কাপালি ২২ রানে আউট না হলে হয়তো বাংলাদেশের সংগ্রহ আরও বাড়তে পারত। অবশেষে বাজে আম্পায়ারিং, রশিদ লতিফের অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ এবং ইনজামাম বীরত্বে মাত্র ১ উইকেটে বাংলাদেশ পরাজিত হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে দুঃসময়ে মুলতান টেস্ট জিতে গেলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হতো বলে ক্রিকেটবোদ্ধারা মনে করেন।

২০০৩/২০০৪ সালের পর হঠাৎ তাঁর ব্যাটে-বলে ছন্দপতন ঘটে। এরপর থেকে ক্যারিয়ারের উত্থান-পতনে হতভাগা অলক কাপালির নির্ঝরে স্বপ্নভঙ্গ হয়; নির্ঝরে স্বপ্নভঙ্গ হয় অগণিত ক্রিকেটপ্রেমীদের। আসা-যাওয়ার মিছিল ও পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে জাতীয় দলে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করতে পারেননি। অতি অল্প বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক আর দ্রুত তারকা খ্যাতিও অকালে ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল বলে অনেকে মনে করেন। মাত্র ১৮/১৯ বছর বয়সে প্রতিভার যে স্ফুরণ দেখাচ্ছিলেন, পরিণত বয়সে সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া তাঁর কাছে প্রত্যাশিত ছিল।

হতভাগা অলক ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ স্কোয়াডে সুযোগ না পাওয়ার কারণ আজ অবধি অজ্ঞাত। ঐসময় ঘরোয়া ক্রিকেটে পাঁচ পাঁচটি সেঞ্চুরির পাশাপাশি ৮ম [২০০৬-২০০৭] জাতীয় ক্রিকেট লিগে সর্বোচ্ছ ৭৪৪ রান করেও নির্বাচকদের মন গলাতে পারেন নি। নির্বাচকদের অবহেলা ও অবমূল্যায়নের শিকার হয়ে ২০০৮ সালে হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে ভারতের নিষিদ্ধ লিগ আইসিএলে খেলতে পা বাড়ান। আইসিএল লিগেও ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন অলক। ৬০ বলে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিসহ ৮ ম্যাচে ৩২৪ রান করেন।

আইসিএল থেকে ফিরে জাতীয় দলে কয়েকবার সুযোগ পেলেও অলকীয় ঝলক সেভাবে দেখাতে পারেননি। তবে অন্যদের মতো নিজেকে প্রমাণ করার পর্যাপ্ত সুযোগ পাননি হতভাগা অলক। ২০১১ সালের পর ঘরোয়া ক্রিকেটের সেরা এই পারফর্মারের পক্ষে নির্বাচকমণ্ডলির নজর কাড়া আর সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। এরই মধ্যে ১৭ তম [২০১৫-২০১৬] জাতীয় লিগে দ্বিতীয় সর্বোচ্ছ এবং ১৮ তম [২০১৬-২০১৭] জাতীয় লিগে সর্বোচ্ছ রান সংগ্রাহক ছিলেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর রান সংখ্যা ৮৪১৭ এবং উইকেট সংখ্যা ২০৭।২০১৫ সালে বিপিএল টি২০’র ৩য় আসরের ফাইনালে হাত থেকে প্রায় ফসকে যাওয়া ম্যাচে অলকীয় ঝলক দেখিয়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে দারুণ এক শিরোপা উপহার দেন।

২০০৩ সালে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও তারকা ব্যাটসম্যান আকরাম খান তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলার আগের দিন রাত্রে অলক কাপালিকে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখক উৎপল শুভ্রকে বলেছিলেন, দেখবেন একদিন অলক ঠিকই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সব রেকর্ড নিজের করে নেবে। বিষয়টি উৎপল শুভ্রের স্মৃতিচারণায় বেশ কয়েক মাস আগে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অলককে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন, তৎকালীন [২০০৩-২০০৭] বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচ ডেভ হোয়াটমোর। ২০০৭ সালে বিদায়ের আগমুহূর্তে প্রথম আলোকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, অলক কাপালি বাংলাদেশ ক্রিকেটে এক অসাধারণ প্রতিভা। আমি মনে করি, তাঁর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়নি, এখনো নিজেকে মেলে ধরার যথেষ্ট সময় রয়েছে।

১৭ টেস্ট, ৭ টি২০ আর ৬৯ ওয়ানডেতেই আটকে আছে জাতীয় দলের দুঃসময়ের কাণ্ডারি এই হতভাগা অলরাউন্ডারের ক্যারিয়ার। যদিও দাপটের সাথে খেলে যাচ্ছেন ঘরোয়া ক্রিকেট। বিপিএল টি২০ পঞ্চম আসরে খেলছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে। ভুলত্রুটি শুধরে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে মুখিয়ে আছেন ৩৪ বছর বয়সী লড়াকু সৈনিক। হাল ছেড়ে দেননি; এখনো স্বপ্ন দেখেন জাতীয় দলের হয়ে লাল সবুজের জার্সি গায়ে জড়াবার। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ভাল খেললে সুযোগ আসবেই। এইক্ষেত্রে তাঁর অনুপ্রেরণার নাম পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিক। যমুনা টিভিকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, মালিক যদি ৩৫ বছর পেরিয়েও জাতীয় দলে খেলতে পারেন, তবে তিনি কেন আশা ছাড়বেন। অবশ্য অলক ভক্তরাও এখনো আশা ছাড়েননি; অলকের ঝলক দেখার প্রতিক্ষায় প্রহর গুণছেন। অলক ফিরবেন স্বরূপে, তাও আবার জাতীয় দলের জার্সি গায়ে; এটা রূপকথার গল্পকে হার মানানোর মতো হলেও অসম্ভব কিছু নয়।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

ক্রিকেট

বৃষ্টির কারণে না হতে পারে ব্যাঙ্গালোর ও চেন্নাই হাইভোল্টেজ ম্যাচ, কোয়ালিফাই করবে কোন টিম

বৃষ্টির কারণে না হতে পারে ব্যাঙ্গালোর ও চেন্নাই হাইভোল্টেজ ম্যাচ, কোয়ালিফাই করবে কোন টিম

যদি বৃষ্টির জন্য না হয় সিএসকে আরসিবির ম্যাচ তাহলে কীভাবে হবে, প্লে অফের সব থেকে ...

বাঁচা-মরার ম্যাচে বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে শক্তিশালী একাদশ ঘোষণা করল চেন্নাই

বাঁচা-মরার ম্যাচে বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে শক্তিশালী একাদশ ঘোষণা করল চেন্নাই

ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছে এ বারের আইপিএল আসরে শেষ সময়। তিন দল সুপার ফোরে জায়গা ...

ফুটবল

কোপার আগে ব্রাজিল শিবিরে নেমে এলো বড় দুঃসংবাদ

কোপার আগে ব্রাজিল শিবিরে নেমে এলো বড় দুঃসংবাদ

কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্ট শুরু হবে ২০ জুন। মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের মরসুম থেকে আমরা মাত্র এক মাসেরও ...

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আয় করা ক্রীড়াবিদের তালিকা প্রকাশ, শীর্ষে রোনালদো, মেসি-নেইমার কোথায়

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আয় করা ক্রীড়াবিদের তালিকা প্রকাশ, শীর্ষে রোনালদো, মেসি-নেইমার কোথায়

আবারও পর্তুগিজ তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো বিশ্বের সর্বোচ্চ আয় করা ক্রীড়াবিদদের তালিকায় শীর্ষে। চতুর্থবারের মতো সর্বোচ্চ ...



রে