বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির-১-এর বাকেরগঞ্জ জোনাল অফিসে স্থাপিত ব্যাংকের অস্থায়ী বিল কালেকশন বুথের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। বুথে জমাকৃত টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়েই কর্তব্যরত কর্মকর্তারা তা আত্মসাৎ করেছেন। গ্রাহকদের ১৩ লাখ ৪২ হাজার টাকা আত্মসাতের ঘটনায় মামলাও হয়েছে।

গত রবিবার (২২ জুন) পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) দায়িত্বরত কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পাশাপাশি অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন।

এদিকে মামলা দায়েরের পর বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বকেয়ার কারণে ১২০ জন গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্নের হুমকি দিয়েছেন।

অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বরিশালের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার আসামিরা হলেন- ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক বরিশালের পোর্টরোড শাখার জুনিয়র অফিসার সাজ্জাদ হোসেন, একই শাখার ম্যানেজার মেজবা উদ্দীন, পল্লী বিদ্যুৎ বাকেরগঞ্জ জোনের সাবেক ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার গোবিন্দ চন্দ্র দাস।

বাকেরগঞ্জের বোয়ালিয়ার মোবাইল ফাইন্যানসিলাম কম্পানির স্থানীয় এজেন্ট লোকমান সিকদার চলতি বছরের ২১ মে মামলাটি দায়ের করেন। আদালতের বিচারক মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন।

লোকমান সিকদার জানান, বাকেরগঞ্জের রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিল পরিশোধের জন্য আসেন। তিনি সেই বিলগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে সংগ্রহ করে পল্লী বিদ্যুতের জোনাল অফিসের নিচে স্থাপিত ব্যাংকের বুথে জমা দেন। গ্রাহকদের জমা রসিদে তিনিই স্বাক্ষর করেন।

বিলের ব্যাংকের অংশে বুথের দায়িত্বরত কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন স্বাক্ষর করেন। এইভাবে তিনি বুথের মাধ্যমে প্রায় ৮ বছর ধরে গ্রাহকের বিলের টাকা জমা দিয়ে আসছেন।

তিনি আরো জানান, তারই ধারাবাহিকতায় গত বছরে বোয়ালিয়া, নন্দপাড়া, বালিগ্রাম, বাখরকাঠীসহ কয়েকটি গ্রামের অন্তত এক হাজারের বেশিসংখ্যক গ্রাহকের বিল বুথে জমা দেন। ওই বছর বুথে গ্রাহকের ৪০ লাখ ৩১৯টা জমা দেন। তার বিপরীতে প্রতিবার একটি সিলিপে ওই কর্মকর্তা টাকার পরিমাণ উল্লেখসহ সিল-স্বাক্ষর দিয়ে লোকমান সিকদারের কাছে দেন।

বুথে জমাকৃত অর্থ নিয়ে অনিয়মের কারণে সাজ্জাদ হোসেন ওই বুথের দায়িত্ব থেকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। পরবর্তী সময়ে বাকেরগঞ্জের পাঁচ শতাধিক গ্রাহকদের কাছে একসঙ্গে তিন থেকে চার মাসের অনাদায়ি বিল পাঠানো হয়। যে বিল আগেভাগেই গ্রাহকরা লোকমানের মাধ্যমে বুথে জমা দিয়েছিল। বিষয়টি লোকমান চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের ম্যানেজারকে লিখিতভাবে অবহিত করেন।

একই সঙ্গে গ্রাহকের টাকা ফেরতের অনুরোধ জানান। তার চার দিন পরে প্রতিকার চেয়ে পল্লী বিদ্যুতের জোনাল ম্যানেজারের বরাবরে লিখিত দেন। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ১১ মার্চ আবার লিখিত দেন। অজ্ঞাত কারণে তিনি কোনো ধরনের সমাধান দেননি বলেও জানান তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পল্লী বিদ্যুতের একটি সূত্র জানায়, গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের সঙ্গে ডিজিএম গোবিন্দ চন্দ্র দাসকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। তার স্থানে ডিজিএম মাজাহারুল ইসলাম দায়িত্ব নেওয়ার পরও তিনিও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে ২১ মে লোকমান বাদী হয়ে তিনজনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন।

লোকমান সিকদার বলেন, ‘গতবছর গ্রাহকের ৪০ লাখ ৩৩৯ টাকা ব্যাংকের বুথে জমা দিয়েছি। তার কাচা রশিদও আছে। কিন্তু জানুয়ারিতে গ্রাহকরা তাদের বিল জমা না হবার বিষয়টি অবহিত করেন। সে অনুযায়ী বুথে গিয়ে জানতে পারি ওই টাকার বিপরীতে ২৮ লাখ টাকা পরিশোধ হয়েছে। সাজ্জাদ দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার সময় জুনিয়র কর্মকর্তা প্রান্ত কুমারের কাছে এক লাখ ৪২ হাজার টাকার বকেয়া বিল রেখে যান। গ্রাহকের চাপে প্রায় ১২ লাখ বকেয়া বিলের পরিবর্তে ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছি। এখনো ১২০ জন গ্রাহকের প্রায় দুই লাখ টাকার বিল এখনো বকেয়া রয়েছে।’

একসময় কালেকশন বুথের দায়িত্বে থাকা ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা পর্যায়ক্রমে একাধিক কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছি। কেউ হয়তো অনিয়ম করে থাকতে পারে। আমি কোনো টাকা আত্মসাৎ করিনি। তবুও পিবিআই কর্মকর্তা আমাকে বরিশাল অফিসে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।’

জোনাল অফিসের ডিজিএম মাজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি শেষ হওয়ার পরে জুনের আগেই তারা কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছেন।’

অর্থ আত্মসাৎ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বুথের কর্মকর্তা আর এজেন্টের মধ্য কী ঘটেছে, সেটা তারাই বলতে পারবেন। এ বিষয়ে একাধিক লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। সেগুলো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়েছি।’

বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘বকেয়ার কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্নের ঘটনা নতুন নয়।’

ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পোর্ট রোড শাখার ম্যানেজার মেজবাহ উদ্দীন বলেন, ‘অর্থ সংকটের কারণে বাকেরগঞ্জের ওই বুথের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। গ্রাহকের কিছু টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আদালতে মামলা হয়েছে। সেই মামলায় সম্প্রতি পিবিআই অফিসে গিয়েছিলাম। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে কালেকশন বুথের কর্মীরা যদি সম্পৃক্ত থাকে, সেটি তদন্তে বেরিয়ে আসবে। সে অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই বরিশালের এসআই আ. রহিম বলেন, ‘ইতিমধ্যে মামলার তদন্ত শুরু করেছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এমনকি বাদী-বিদাবীর পাশাপাশি গ্রাহদের সঙ্গে কথা বলেছি। তদন্তে যা আসবে সেটি প্রতিবেদন আকারে আদালতে দাখিল করা হবে।